Monday, August 8, 2016

সুইসাইড স্কোয়াড - ডিসি হলেই আমাদের অবিরাম লালাক্ষরণ

সেই সময়টা এসেই গেল যখন বহু-প্রতীক্ষিত সুইসাইড স্কোয়াড বেরোবে। প্রচুর অপেক্ষার অবসান। ফ্যানেরা পাগল, সাথে আমরাও। আমরা মানে যারা নব্য-কমিক্স-এন্থুসিয়াস্টিক*। কমিক্স বলতে জানি বাঁটুল, হাঁদা ভোদা, হী-ম্যান, চাচা চৌধুরী। অবশ্য মাঝে মাঝে অ্যাস্টেরিক্স, টিনটিন আর ফ্যান্টম চুদিয়ে আন্তর্জাতিকতা মারাতে যাই। তাও ভাগ্যিস নীরেন্দ্রনাথ সবগুলো টিনটিন অনুবাদ করেছিলেন, নাহলে আমাদের টিনটিন-ট্রিভিয়া সেই "ঢালের খোঁজে"তেই শেষ হয়ে যেত। যাগগে, যা বলছিলাম - বিদেশী কমিক্স। ডিসি, মার্ভেল ইত্যাদি (আর একটাও নাম জানি না কিন্তু)। এমনিতে নতুন বই-এর কোনো ক্যারেকটার সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই ওই জোকার আর হার্লিকুইন কে ছাড়া। তাও হার্লিকুইনের পরিচিতি ওই জোকারের ছায়াসঙ্গিনী হিসেবে। কিন্তু মাতামাতি না করলে হবে কেন?! লাফানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। সেই লাফে কী নেই, টি-শার্ট কেনা, পারলে কমিক-কনে গিয়ে সেলফি তোলা, দুয়েকটা উইকিপেজ বানিয়ে বা এডিট করে সেই কথা লোকজনদের সামনে একশোবার করে বলা। আবার কেউ যদি মাঝে অবজ্ঞাসূচক ভাবে বলে ফেলে "কমিক্স, মানে কার্টুন?!", তখন আমাদের গোঁসা দেখে কে।

অন্য দিকটা সবাই জানেন, প্রিটেনশান। এটা অবশ্য এক সময় বাঙালীদের কপিরাইট ছিলো, এখন পাঞ্জাবী, মাদ্রাজী, চীনে, কালিম্পঙ্গি, কাফ্রী, এস্কিমো সবার এই বাই হয়েছে। মহামতি গোখলে আর ভারতেই আটকে নেই, ওনার উক্তি বিশ্ববন্দিত হওয়ার মুখে। যেটা বাঁড়া বুঝতে পারলাম না, তার মত আর জিনিস হয় না ভেবে নিতে হবে। অতএব ডিসি জিন্দাবাদ। মার্ভেলপ্রেমীদের তাও এই নাকউঁচু ব্যাপারটা নেই। সবাই মিলে আসলো, ঝারপিট হল, টোনি স্টার্ক কেত দেখালেও মনটা খুব ভালো - হয়ে গেল বাড়ী চলে আসলাম। ডিসি ফ্যানবয়দের ব্যাপার কিন্তু আলাদা। সিনেমা দেখতে যাই যেন পোলিশ চলচ্চিত্র উৎসব চলছে। মারপিট দেখালে একটু খেলো বলে মনে করলাম। বাড়ী ফিরেও শেষ নেই, রাজ্যের ট্রিভিয়া পড়ে পরের দিন বন্ধুদের সামনে গ্যাঁজলা বের করতে হবে। তা যতদূর মনে পড়ে, এই ঢ্যামনামিটা শুরু করে দিয়ে গেছেন ক্রিস্টোফার নোলান। কমিক্স-ভিত্তিক বই কিন্তু একটা বাঁধা নিয়মে এগোচ্ছিলো। একদম আউট-অফ-দ্য-পাড়া চরিত্র, পাল্পীয় ব্যাকগ্রাউন্ড, যাত্রাসুলভ ক্ল্যাইম্যাক্স - এসব ২০০৭ পর্যন্ত ঠিকই গড়াচ্ছিলো। নোলানের চেষ্টা কিন্তু প্রথমদিকে খুব একটা পাত্তা পায়নি। হঠাৎ কী হল, মহকুমা সুদ্ধু লোকজন জোকারের জয়জয়কার শুরু করল। অ্যাকচুয়ালি, এই একটা জিনিস আমার কাছে সত্যি এখনো রহস্য। সে যাই হোক, তারপর থেকে সুপারহীরোদের মানবিক করার দায় সবাই ঘাড়ে নিয়ে নিলো। আর আমরাও সেই মতুয়ায় গড়াগড়ি দিতে লাগলাম। "ব্যাটম্যান বিগিন্স" যে কী, খায় না মাথায় দেয় আমরা জানি না। "দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস" দেখে নেটে পোস্ট পড়েছিলো "তাহলে নোলানও ঝোলান"। এদিকে "দ্য ডার্ক নাইট" কে নিয়ে কিছু বলা যাবে না, কারণ প্রত্যেক শুক্রবার কিন্তু বাতাসা কি নকুলদানা দিয়ে হীথ লেজারকে পুজো করতে হয়। তো সেই থেকে যে গুণমুগ্ধ ভক্তকূল তৈরি হল, সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। ঝগড়ার কারণটারণগুলয় ছাড়া "সিভিল ওয়ার" কিন্তু বেজায় ভালো একটা সিনেমা, কিন্তু তাও আমাদের বলতে হবে "ডন অফ জাস্টিস" এর মত আর হবে না।

কিন্তু ভেবে দেখতে হবে যে কমিক্স-নির্ভর বইগুলোর যে একটা দায় থাকে ফর্মাটের প্রতি, সেটা হয়ে গেছে টিম বার্টনের "ব্যাটম্যান" বা স্যাম রাইমির "স্পাইডারম্যান" গুলোয়। পোস্ট-মর্ডানিজমের নামে সেগুলো ভাঙ্গাও হয়েছে "ওয়াচমেন" বা "স্কট পিল্গ্রিম"এ। অতএব আর স্টাইলের দোহাই টোহাই না, এখন পাতি যেটা চলছে সেটা হল "বিন্নেস"। সে মার্ভেলই বলুন বা ডিসি, কেউ এখন কম যায় না। হ্যাঁ, স্ট্র্যাটেজি আলাদা। মার্ভেল যদি বলে দেখ কত বেণীআসহকলা চড়িয়েছি, ডিসি পরছে ছোট্ট টিপ, ডার্ক লিপিস্টিক আর ডার্কার শাড়ী। সে তো সবাই ছবি বিক্রি করতে চায়।কিন্তু মার্কেটিং হতে হবে একমুখী। সেই জন্যেই তো "বোম্বে ভেলভেট"এর জেনরটা কী, মানে কাশ্যপের কেত শুনবো না কাপুরের কেরামতি দেখবো, তাই বুঝে উঠতে পারলাম না কেউ। নাহলে ওয়ান্ডার ওম্যান, যিনি ৩০/৪০ বছর ধরে একটাও অ্যাপিয়ারেন্স পাননি, তিনি ডিসি-বিশ্ব বানানোর তাগিদে হুট বলতেই একটা নিজের ফ্রাঞ্চাইজি পেয়ে যান?! কত বড় ধৃষ্টতা হলে কেউ বলতে পারে ২০২৭ পর্যন্ত আমার প্ল্যান রেডি। আরে বাবা, ওরাকলের মত প্রজেক্টেও দুই বছরের বেশি বাজেট বানানো হয় না, তো এ কী। এ তো আমাদের ভারতীয় কুর্সি হয়ে গেল, একবার পাঁচ বছর টিকে গেলাম মানে নাতবউএর মুখ দেখা পর্যন্ত আর কোনো চাপ নেই। এদেরও তাই চলছে। কারণও আছে। আমাদের তো বয়স কমছে না, তাও দুপয়সা বেশী খরচ করে আমির-শাহরুখ-সলমন দেখবো না, এদিকে পারলে "গেম অফ থ্রোন্স"এর ডিভিডি কিনে নিই। নব্বইএর দশক পর্যন্তও তাও ড্রামাগুলো বছরের সেরা ছবি হত - তা সে সেক্স টেক্স একটু বেশী থাকতো এই যা। ২০০৫ এর পর থেকে আর কথাই নেই, কোথায় কোন কমিক্স থেকে এবার ভাঙ্গা হবে আর পোস্ট-ক্রেডিট সিনে আর কোন চরিত্রের ক্যামিও, সেই চিন্তায় লোকে যৌবনজ্বালা পড়া ছেড়ে আইএমডিবি ট্রিভিয়া পড়ছে। বেদরকারী জিনিসগুলোতে প্রচুর সিরিয়াসত্ব আরোপ করে আমাদের আমোদ আর ঘ্যামের অন্ত নেই।

অবশ্য যাই হচ্ছে আর যাই হবে, তাতে অন্তর্জালকে কোটি কোটি কুর্নিশ। এটি না থাকলে আমরা আঁতেলচন্দ্ররা কী করতাম ল্যাদ খাওয়া ছাড়া। দুটো উদাঃ দেওয়া যাক যেমন। আজকাল একটা নতুন কায়দা চালু হয়েছে - ট্রেলার ব্রেকডাউন। মানে একটা ট্রেলার এর ব্যাবচ্ছেদ। কেভিন স্মিথের গুলো নাকি শুনেছি লম্বায় মূল সিনেমার চেয়েও বড় হয়ে যায়। তা একটা ট্রেলার ব্রেকডাউনে (বা বইএর প্রিভিউ/রিভিউ, বা রিঅ্যাকশান) কী লাগে। না, একটা এডিটর কারণ মুভিমেকারে বহুত ফিচার নেই, একটা ভয়েসোভার, রেফারেন্সের জন্যে প্রচুর ছবি আর সিধুজ্যাঠাসুলভ জ্ঞান। তার মানে একটা ভিডিও যদি বা আমি সাইবার ক্যাফেতে গিয়েও আপলোড করতে চাই, তার আগে আমাকে দৌড়োতে হবে আলিপুর, ফ্রেঞ্চ এম্ব্যাসি, ম্যাক্সমূলার ভবন, ব্রিটিশ কাউন্সিল আর অন্ততঃ দুবার টেকনিশিয়ান্স স্টুডিও। পারলে কয়েকবার কলেজ স্ট্রিট আর সেমিনার টেমিনার (if any)। অত ভেবে কাজ কি, দ্বিতীয় কেসটাই ভাবুন। এই যে আমি চন্দ্রিল ভট্টাচার্য হওয়ার ভান করেই যাচ্ছি, তার জন্যেও কিছু না হোক একবার গোলপার্ক, তিনবার প্রেস (বাংলা টাইপফেস সহ) আর চারবার পাঠাগারে যেতে হত। তা সে সবকিছু পাতি বসে বসে হয়ে যাচ্ছে বলেই কিন্তু যত সব এন্থুসিয়াজম। পোদ নাড়াতে হলে ওই তকমাটা অ্যাফর্ডেবল ছিলো না। আর কুর্নিশ সেই সব মানুষদের যারা এইসবের তোয়াকা না করেই আঁতলামি মারিয়ে যেতেন ও যাচ্ছেন। এই ট্রেলার ব্রেকডাউনের কথা যখন আস্লোই, তখন চট করে সুইসাইড স্কোয়াডের ব্রেকডাউনটা শেয়ার করা যাক। এইটা দেখে প্রত্যাশা, মানে যাকে বলে প্রত্যাশা যদি বিচি হত, এক্কেবারে মাথায় উঠে গেছিলো। আসলে এই চ্যানেলটায় বেশ ভালই ব্রেকডাউন করে, আর "গেম অফ থ্রোন্স"এর অ্যানালিসিসও শুনেছি খুব সুন্দর হয়, দেখা যেতে পারে।




~এবারে বই কেমন হল সেটা~

ভালোমন্দ পরের কথা, যেই প্রত্যাশা বলছিলাম না আগের প্যারায়, সেটা ম্যাচ করেনি। কেন করেনি, সেইসব বলতে কিন্তু প্রচুর শো অফ করা হবে, নানা ঘাটের রেফারেন্স টানা হবে। প্রথমেই বলা যাক থীমটা নিয়ে। অ্যান্টিহীরোর গল্প নতুন কিছু না, প্রচুর দেখা যায়। সেই "অমানুষ", "খলনায়ক" থেকে হালের "মেগামাইন্ড" বা "ডেসপিকেবল মি" সিরিজ। মানে বলা হচ্ছে যাদের আপনার সমাজ বাজে ও জলিল ভাবে, তারাও একটা সোনালি হৃদয় ধারণ করে থাকে। সেই "মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ" ধারণার থেকে জাত। তো আমি ভাবছিলাম যে নতুন আর কি দেখাবে। প্লাস ওই "ডিসির উপর বিশ্বাস হারানো পাপ" থিওরি। মানে এবার মনে হয়, আফটার অল ভিলেন তো, সত্যিকারের ডার্ক দেখাবে। আসল হারামী, মানে ওই বাচ্চা, ফ্যামিলিও তোয়াক্কা করে না, আর ভ্যালুজ ট্যালুজ কিছুই নেই। তা সেটা কিছুই না, সবাই "আসলে তো একা, ওদের দেখার কেউ ছিলো না" বলে রেন্ডিরোনা আছে। তারপরে ক্যারেক্টার জাস্টিফিকেশান নেই। ডায়াবলো আর বুমেরাংদের মত অসাধারণ (শুনেছি) চরিত্রগুলো শুধু হয় সততা পাকাচ্ছে নাহলে এদিক ওদিক তাকিয়ে অবাক হচ্ছে। স্লিপনটের সাথে যা হল সেটা অপ্রত্যাশিত আর সত্যিই যাকে বলে ডার্ক। আর যে টাইপকাস্ট ভাবে জোকার-হার্লিকুইনের ভালোবাসার ফ্ল্যাশব্যাক দেখানো হল সেটার থেকে দশগুণ ভালো ছিলো আমাদের "দুই পৃথিবী"র ফ্ল্যাশব্যাকগুলো। আর পলিটিক্যালি কারেক্ট হলে বলতে হয় যে জ্যারেড লেটো সেরা জোকার কোনো ভাবেই নয়। আরেক অসাধারণ ডার্ক ক্যারেক্টার হল অ্যামান্ডা ওয়েলার। ভালো অ্যাডমিনিস্ট্রেটারের রোল, বেশ ম্যানিপুলেট করছে দেখাচ্ছে, চরমাবস্থায় কলিগরাও কেউ না এইসব নিয়ে ভালো রোল হলেও ছোটো। বাকী টিম ওই "বদমাশ কোম্পানি"র মত। আর যেটা ব্যাটম্যান-ছবিতে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব পেয়ে এসেছে এতদিন, সেখানেই একদম হেগে দিয়েছেন এনারা। ভিলেন হয়েছে "এক্স-মেনঃ অ্যাপোক্যালিপ্স"এর মত, বলা ভালো তার মিনি-সংস্করণ। এটা একদম পাতে নেওয়া যায় নি। আর একটা কথা না বলে পারছি না, সেটা হল পোস্ট-ক্রেডিট সীনের পাগলামো। করতেই হবে একটা রিচুয়াল হয়ে গেছে। স্পয়লার হবে তাও বলি, লাস্ট সীনে দেখাচ্ছে ব্যাটম্যান অ্যামান্ডার থেকে এক্স-মেন সুলফ লোকের ফাইল জোগাড় করছেন। এই তো কদিন আগে একটা মেলের অ্যাটাচমেন্টে সব অসাধারণ ফাইলটাইল পাওয়া গেল, আবার কেন?!

____________________________________________________________________________________________________
*এই নব্য ব্যাপারটা হুতোমের নব্য-বাবু বা তৃতীয় বিশ্বের নব্য-নাৎসিদের মতই। ভুল বুঝবেন না, আজকাল যতই নব্য-নাৎসি একটা খিস্তি বলে পরিচিত হোক না কেন, আমার ধারণা কথাটা চালু হয়েছিল যখন নাৎসি হওয়াটা একটা ইন-থিং ছিলো।