Monday, October 31, 2016

জুলফিকার - আর কতবার শেক্সপীয়ার মারলে তবে মাএস্ট্রো বলা যাবে

আজকে এইমাত্র বসে "জুলফিকার" দেখলাম। ওরে বাবা, ভাবা যায়, শ্রীজিৎ নাকি শেক্সপীয়ার বানাচ্ছেন। তাও আবার একটা না, দু-দুটো। হলিউডের স্বর্ণযুগে যাকে বলা হত "ডাবল ফিচার"; মোস্ট রিসেন্ট সময়ের উদাঃ হল "গ্রিন্ডহাউস" (যেটা থেকে আমরা ডাবল ফিচার সম্পর্কে জানলাম আরকি)। এক্সপেক্টেশনের বাড়াবাড়ি তো অবশ্যই, কারণ ওই, এই পুরোনো, আঁতলামো। এমনিতে সংস্কৃতি চোদালে আমাদের চোখ গোল্লা গোল্লা হয়ে যায়। তারপরে আবার আজকাল এই পপ কালচারের একটা গড্ডালিকাপ্রবাহ শুরু হয়েছে, যত পুরোনো এবং বাজে বই, সেগুলো নাকি কাল্ট। সেই একই ব্যাকরণে, শেক্সপীয়ার করলে তো মাৎ মাৎ। এদিকে কিন্তু প্রশ্ন করা যাবে না যে কজন শেক্সপীয়ার জানে। ট্রিভিয়া দেখিয়ে ফাটিয়ে দেবে সবাই। আবহাওয়া ঠান্ডা হলে একবার যদি জিগ্যেস করা যায় "দাদা, ম্যাকবেথ আসলে ছিলো টা কে?!" সবাই দেখবেন মদের গ্লাস হাতে উসাইন বোল্টের কথা বলছে। উসাইন বোল্টের ব্যাপারে ডিটেলসে জিগ্যেস করতে গেলে শুরু হবে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর দারিদ্রের গল্প*। হ্যাঁ, এতটাই অধঃপতন হয়েছে আমাদের। কিংবা, জনপ্রিয় তত্ত্ব মানলে বলা চলে যে পাবলিক চিরকালই এতটাই উপর উপর জানে। চোখের সামনে এখন দেখতে পাচ্ছি বলে এটা খারাপ লাগছে। সাধে কি আর ইতিহাস রাজাগজাদের নিয়ে লেখা হয়েছে?! আমিই তো শো অফ করার আগে বাঙলায় অনূদিত "জুলিয়াস সিজার" আর "অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা" পড়ে নিলাম টুক করে।

মনে আছে (= উইকিপিডিয়া বলছে) যে আশির দশকের শেষের দিকে ওই ডিজনির একটা নবজাগরণ হয়েছিল "দ্য লিটল মার্মেড", "বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট" এই বইগুলো করে। মানে পড়ে যাওয়া "বিন্নেস"কে মাথায় তোলা হয়েছিল এই ন্যাকাচোদামো গুলো দিয়ে। অসম্ভব সব নারীচরিত্র দিয়ে ভরা এই সিনেমাগুলো আমাদের মাথা খেয়েছিলো একসময়। তবে সে কথা না, পয়েন্টে আসি। তো এখন আবার বাংলা বলুন, হিন্দি বলুন, এই একটা সেম জিনিস শুরু হয়েছে শেক্সপীয়ার নিয়ে। ডিকেডে ডিকেডে এই ভদ্রলোকের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে একটা নতুন থিওরির আমদানি হয়, এটা অবশ্য সেই শেক্সপীয়ারের সময় থেকেই চলছে। তা এই কদিন আগে নাকি পাঁচশো বছর না কি একটা গেছে। ব্যাস আর যায় কোথা। সেই যে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবার্ষিকী বলে একটা বিশ্রী কাণ্ড হয়েছিল, এটা তারই বিলেতুতো ভাই। তবে অত বড় রেঞ্জে তো করা যায়না, কারণ বাইরে বিশাল বড় বড় সব হনু বসে আছেন। বাইরে যাই হয় তাই সবচেয়ে সেরা সেটা বলছি না, কিন্তু বাইরের পাবলিক আর্টিস্টকে সুযোগ দেয় অনেক বেশী। তাই এক্সপেরিমেন্টের রেঞ্জও, তুলনামূলকভাবে, অনেক ব্যাপ্ত। মেঘনাদ ভট্টাচার্য যখন "দায়বদ্ধ" রিলিজ করেছিলেন, তখন সেই "এই দুটো তিলের জন্যে জীবন দিয়ে দেওয়া যায়" সিনটা নিয়ে খুব হইহই হয়েছিল। পরে নির্দেশক/রা কিছু একটা বাজে যুক্তি দিয়ে পালাটাকে কন্টিনিউ করেন। ওই যেমন হেলথকেয়ারমূলক ছবি বলে "নো স্মোকিং"কে হলে পাঠানো হয়েছিল। সে যাই হোক, "দায়বদ্ধ"র প্রথম রজনীর দুয়েক বছরের মধ্যেই "ইকুয়াস"এর নতুন ভার্শানে অভিনয় করল ড্যানিয়েল র‍্যাডক্লিফ, একদম সেই ল্যাংটা হয়ে বালের চুলটুল দেখিয়ে। মনে রাখতে হবে, তখন হ্যারি পটারের তিন না চার নাম্বার চলছে। আমাদের দেশে শিশুশিল্পী তো দূরের কথা, শিশুশিল্পীর ছোটোমামার (অ্যাডাল্ট) গায়েও যাতে যৌনতার কোনও ট্যাটু না লাগানো হয়, তার জন্যে আলাদা মরাল পুলিশ আছে। তো সেই কারণে, শেক্সপীয়ার, বা সোফোক্লিস, বা কালিদাস, বা আর্থার মিলারকে নতুনভাবে দেখার সাহস হয় না আমাদের দেশের শিল্পীর। হ্যাঁ, শিল্পীই। একজন খারাপ শিল্পীও কিন্তু শিল্পী। সাহস হয় না, পয়সা নেই, পাবলিক আসে না, ধক নেই, চিন্তাশক্তি উইকিপিডিয়ায় আবদ্ধ, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এখনকার লোকের (মাইরি, আমার মা মাসিরাও হোয়াটসঅ্যাপ করা শুরু করেছে) কাছে আর কিছু থাকুক না থাকুক, একটা স্মার্টফোন আছে। আর তাতে খুব কম করে বললেও, মাঝে মাঝে ইন্টারনেটের রিচার্জ করানো হয়।

অতএব, ফিল্মমেকাররাও সত্যিকারের আন্তর্জাতিক হওয়ার লোভ সামলাবেন কি করে?! সেই কপিকলে যেমন পড়ছেন সঞ্জয় লীলা বনশালি, তেমনি অঞ্জন দত্ত। শ্রীজিৎ আর অপর্ণার তো এরকম টুকটাক হাত মারার স্বাভাব আছেই। দেখুন, ইউরোপ টিউরোপের কথা জানি না, বা কোরিয়া-জাপান, কিন্তু হলিউড আর বলিউডে (এবং তার ছানাপোনারা) সিনেমাকে আর্ট থেকে বহুদিন হল ব্যাবসার জায়াগায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে কালাপানি থেকে অদূর ভবিষ্যতে কোনো মুক্তি নেই। সেখানে সবাই অন্য লোকের কথা ভেবেই সিনেমা বানায়। অতএব, যতটা পারো হাল্কা কর। আরে বাবা, একজন লেখকের যখন সমগ্র ছাপানো হয়, তিনি বেঁচে থাকলে সেইসব গল্পগুলোকেও একবার দেখে নেন আরেকবার এডিট করা আয় কিনা। আর এতো সেই পাঁচশো বছর আগেকার। বিশাল ভরদ্বাজের কথা বলতে ভুলে গেলাম তো। ওই একটা "মকবুল" করে ফাটিয়েছিলেন। তারপর তো সেই সব গয়ংগচ্ছ। তাও সেই নাক টাক কেটে হ্যামলেট করতে হল কাশ্মীরে। আর এদিকে, বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এসএমএস ভূত। আমাদের ছোটোবেলায় রথ, বারুনী বা ঝুলনের মেলায় এইরকম চটি বই কিনতে পাওয়া যেত। হারবার্ট থাকলে বলত, "আরে বাবা, ভূতের ইন্টারপ্রিটেশান কি অত সোজা - যাঃ যাঃ"। রোমিও জুলিয়েট নিয়ে কিন্তু আমাদের দেশে সিনেমা কম হয়নি। অনেকে আসল গল্প না জেনে, অনেকে কপিরাইটের ভয়ে টাইটেল কার্ডে আর শেক্সপীয়ারের নামটাম দেননি। সেইসব ছোটোলোকপনা অবশ্য বিদ্যাসাগর মশাইও করেছেন। কিন্তু যেটা সবচেয়ে খারাপ লাগে, লোকে একটা জিনিস করে বলছে, "এই অ্যাক নূতন"। সে তো তাও বোঝা যাচ্ছে, কোম্পানির মাল বিক্রির তাগিদ আছে। কিন্তু কনজিউমারদের আপনি বোঝাতে যান, এইসব সত্তরের দশকে লোকে করে ফাটিয়ে দিয়েছে, তারপরে যেই সে খাটের তলায় লেপ ঢুকিয়ে রেখেছে, তা আর কারুর মনে নেই, হয়তো সেইসব লেপকাঁথা ওয়ার্ড সেলে ফ্রিতে কেউ নিয়ে নতুন জিনিস বলে আমাদের দেখাচ্ছে, লোকে আপনাকে বলবে স্নব। কে জানে, বলা যায় না, হয়তো ফেসবুক থেকেই বের করে দিলো বা আপনার হ্যাশট্যাগগুলো আর টুইটই করলো না। তার থেকে বাবা থাক, ট্রিভিয়া আইএমডিবিতে, লোকশিক্ষা থিয়েটারে আর জ্ঞানবুদ্ধি আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে সুন্দর, আর শেক্সপীয়ার ঘরে ঘরে।

আরো শুনুন, কয়েক বছর আগে ওই রজত কাপুর এণ্ড কোং মিলে একটা মিডসামার নাইটস ড্রীম এর বোম্বাই এডিশান বার করেছিল, তাতে ওই বাগানের দৃশ্যটাও ছিলো, পারলে দেখুন আর ভাবুন আর্ট ফিল্মের নামে আর কত গাঁজা খাবেন..




~এবারে বই কেমন হল সেটা~

খুব একটা প্রত্যাশা ছিলো বলব না, কিন্তু চমৎকার ট্রেলার বানিয়েছিল শ্রী ভেঙ্কটেশ টীম। বেশ একটা অ্যাভেঞ্জার অ্যাভেঞ্জার গন্ধ আসছিলো। পুজোয় টাইম পাইনি দেখার, এই আজকে একটা ব্লগে আপলোড করেছে, তাতে প্রিন্ট হেব্বি হাইফাই না, কিন্তু কথা পরিষ্কার, আর সাবটাইটেলও ছিলো। এবার তার জন্যে কোনো সীন-টিন বাদ গিয়ে থাকে, তাই সম্ভাব্য ভুল ব্যাখ্যার জন্যে আগে ক্ষমাটমা চেয়ে নিচ্ছি। সীনের নামে মনে পড়ল, দারুণ কয়েকটা কথার পান আছে, অ্যাট লিস্ট মদ খেয়ে তো শুনতে হেব্বি লাগে। গল্পটা যখন রাহুলের ভয়েসোভারে শুরু করল, মাঝখানে আরো কয়েক জায়গায় হলে মন্দ লাগতো না। কিন্তু এটা মেজর ত্রুটি নয়। যেখানে ওই যীশু কৌশিককে পুরো কনভিন্স করে নিলো, সেটা অত নাটকের সেকে নাটকের মত না বানালেও পারতো, অত দূরে থেকে আজকাল কেউ কথা বলে নাকি?! তারপরে ভরত কলের খুনের সীনটাও আরো কনভিন্সিং দেখাতে পারতো। শ্রীজিত কবে বুঝবে যে ওনার ভাড়া করা ক্যামেরাম্যান (থুড়ি, ডিওপি) এইসব সিন নিতে পারেননা। মনে পড়ে যায় "মিশর রহস্য"তে সেই ছড়ানোর কথা। সে অবশ্য প্রথম সীনেও সেই মনমোহন দেশাই মার্কা অ্যাকশন দেখিয়েছে, কিন্তু ক্যারেক্টার ইন্ট্রোডাকশনের জন্যে ওটা দরকার ছিলো। কারণ, অনিমেষ সেই কবে বলে দিয়েছে, শ্রীজিৎ স্ক্রিপ্ট লিখতে পারেন না। তারপরে প্রসেনজিৎকে খুনের সীনটা যেন বলা নেই কওয়া নেই, হুট বলতেই হয়ে গেল। এখানে অবশ্য ডিরেক্টর বলবেন যে, ওই কাসকার (সরি, অভিনেতার নাম মনে নেই) চরিত্রটাকে ওইরকমই বলা হয়েছিল আবহাওয়াটা ট্রিগার করার জন্যে, কারণ কৌশিকের সেন্টুকে ভরসা নেই। কিন্তু তার মানে তো এমনভাবে সুবিধাজনকভাবে ক্যারেক্টার বানানো যাতে কথা কম বলানো যায়। দেবের সব কিছু মাফ করা যায়, ওই জঘন্য ট্যাটুটা ছাড়া। সবচেয়ে কম রোল পেলেন জুন মালিয়া, অবশ্য এটাই প্রথম বার না। এটা প্রায় ট্রিভিয়া লেখার মত যে "বাইশে শ্রাবণ"এর মত এখানেও সবচেয়ে কম টাইমের চরিত্রটিকে মেরে ফেলা হল। জুন মাঃ কী ছিলেন, আর কী হইয়াছেন। তবে দারুণ সীনের অভাব নেই। বেস্ট লেখা চরিত্র বোধ হয় নুসরতেরটা, তবে লাস্টে যা হল, সেটা বাড়াবাড়ি। স্পয়লার অ্যালার্ট হয়ে যাবে এটা, কিন্তু সাপের আধুনিক ভার্শান কোনোভাবেই বৈদ্যুতিন তার হতে পারে না। ভেবেছিলাম কৌশিক আর যীশু ফাটাবে, একজন ধেড়িয়েছেন, একজনের ঠাণ্ডা লেগেছিলো। খালি খালি ভয়েস পালটে লাভ হল কিছু?! পরম সেই দিক দিয়ে, সব বারের মতই, মেরে বেরিয়ে গেছে। অঙ্কুশের ট্রান্সফর্মেশন তো বইতে ছিলো না, সেটা দেখিয়েছে ভালো। দুটো বই থেকে নিয়েছে বলেই, আদ্ধেক আদ্ধেক করেনি, এটাও বেশ হয়েছে। আরেকটা কথা, কবি পুরো রায়তা ছড়িয়েছেন স্ক্রিনে। রাহুল, সুজন দুজনেই অসাধারণ। এটা থেকে যেটা মনে পড়ে গেল, ওই প্রসেনজিৎ খুনের পরে একজন পুলিশ অফিসার যে ভয় নিয়ে পালাচ্ছে, সেটা চমৎকার, প্রায় নিজেরই ভয় ভয় লাগে। তবে বইয়ের সেরা পার্টটা হল নামকরণ, এটার আর হাঁড়ি ভাঙলাম না এখানে।

__________________________________________________

*এবারে শাপমোচন, হ্যাঁ। মানিক সরকারের গল্প এখনকার দিনে প্রায় সেই রাদুগা প্রকাশনের রূপকথার মতই।