Sunday, April 24, 2016

ফ্যান - আর দুনিয়া ভর স্টিরিওটাইপকন

যশরাজের কথা যখন উঠলই, একেবারে "ফ্যান"এর রিভিউটাও করে ফেলি। শাহরুখ খান আর কতবার নিজের রোলটা নিজেই করবেন?! সেই যে শুরু হয়েছিল "ওম শান্তি ওম"এ, তার পরে "লাক বাই চান্স" (তাও এতে নিজের নামটাই ব্যবহার করেছিলেন এই রক্ষা), "বিল্লু বারবার" হয়ে এদ্দিন পরে এই। তবে এটা শুধু বলিউড ছবিতেই সীমাবদ্ধ নেই। উত্তমকুমার করেছেন, মিঠুন করেছেন, জুহি চাওলা করেছেন, জ্যাক ব্ল্যাক করেছেন, হালে প্রসেনজিত বা ঋতুপর্ণাও বাদ নেই। কিন্তু একটা সীমা রাখা দরকার। প্রত্যেকদিন দাদা বউদি বা আন্ধ্রা হাউসের বিরিয়ানি খেতে ভালো লাগে না। গুণীরা মানবেন, বলবেন "সব সেক্স না"। লোকজন টাইপকাস্ট হয় ঠিকই, কিন্তু সেটা থেকে তো বেরিয়েও আসতে লাগে, নাকি। কিন্তু এইসব কথা সেই আদিযুগ থেকে চলে আসছে, কেউ শোনে না। আমরাও সেই একই জায়গায় আটকে গেছি। অফিসে জানি এই কাজটা আমি ব্যাপক পারি, অতএব এটাই বারংবার করে এমপ্লয়ি অফ দ্য উইক। তো এটাও বোঝা দরকার যে শাহরুখ খানও সেই হিসেবে নিজের কাজ করছেন। ঠিক আছে। এই যে আমি জনি ডেপের ফ্যান সাইনবোর্ড লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই, তিনিও তো প্রত্যেক সিনেমায় সিরিওকমিক রোল করেন আর প্রচুর মদ খান - তার বেলা?! যার ছবিটা খালি ঠাকুরঘরে তুলতে বাকি রয়ে গেছে, সেই টম হ্যাঙ্কস তো প্রত্যেকটা সিনেমায় সেমি-বোকা আর আল্ট্রা-ভালো ক্যারেক্টার করেন (এক 'দ্য লেডিকিলার্স' বাদে, যেই কারণে লোকে পাতে দেওয়ার প্রয়োজন লোক ভুলে গেছে)। সকলের গুরুদেব মার্টিন স্করসেসে* তো যে গল্প বানান তাতেই একটা লোকের উত্থান দেখানো হয় একটা ভয়েসওভারের সাথে, আর সেই যে বেসিক্যালি খারাপ হয়েও সবার নয়নমণি হয়ে গেছিল, সে খুব একটা নোংরা কাজ করে ফেলে। ইমতিয়াজ আলি তার নবতম ছবিতে বলেছেন, সবই সেম  গল্প, ক্যারেকটার আলাদা অল্প অল্প। যদিও মনে হয় ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে পাবলিকের অভিযোগের একটা জাস্টিফিকেশন ছিলো এটা, কিন্তু কথাটা খাটে সিনেমাজগতের ট্রেন্ড ফলোয়ারদের ক্ষেত্রে। অনুরাগ কাশ্যপের গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর হিট হওার পরে এইসব গুলিগালা নিয়ে সিনেমা করা কত বেড়ে গেছিলো মনে আছে - "বুলেট রাজা", "রিভলভার রাণী", "বন্দুক", "কোয়েলাঞ্চল", "মীরাঠিয়া গ্যাংস্টারস"। "গুণ্ডে"ও তো একই ফর্মুলার ফসল। তবে বম্বের মোটা কাপড়কে খিস্তি মারলেই তো হবে না, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখাও দরকার। অস্কার থীমের কথা তো সবাই জানেন। প্রান্তিক চরিত্র না হলে পাওয়া মুশকিল। মানে পাগলা, গে বা ক্যালানে ক্যারেক্টার করলে, আমাদের যেমন এসসি সার্টিফিকটের সুবিধা আছে, প্রাইজ বাঁধা। অবশ্য ইউরোপীয় চরিত্র হলে আর কোনো এক্সট্রা অ্যাডেড ফিচার লাগে না কারণ মার্কিন বোর্ডের কাছে সমুদ্র পার হলেই প্রান্তিক। এগুলো সব ফিল্ডেই এক। অতএব ওই একই ছাঁচে ঢেলে প্রোডাক্ট বের করতে থাকা আর আমাদের ১৪০ টাকার টিকিট আর ১১০ টাকার পপকর্ণ আর ৫০ টাকার জলের বোতল দিয়ে সেই গেলা। যা বলছিলাম। তো সেই টুকরো টুকরো ডিসিশানের পরিণতি হোলো ফ্যান। সমালোচকরা সবাই নাকি পাগল হয়ে গেছেন অভিনয় দেখে। আনন্দবাজারের তো মুখ দিয়ে ফেনা উঠে গেছে। সিরিয়াসলি, এবিপিপ্লাসের রিভিউ/প্রিভিউ/পোস্টভিউ পড়ে মনে হয়েছিল যে প্রতিদিন পড়ছি (প্র -> তৃ -> ম -> শা -> ফ্যা) নাকি সত্যি সত্যি এত ভালো হয়েছে। অবশ্য পাপী মনের কি এটা মনে থাকে যে এই পেপারেই "চাঁদের পাহাড়"কে টলিউডের শোলে বলা হয়েছিল। তো দেখলাম সিনেমা এবং কিছুই পেলাম না। না, কয়েকটা জিনিস হেব্বি ভালো হয়েছে, যেমন হল শাহরুখ খানের নিজের রোলটা। সেটা "বিল্লু" বা "ওম শান্তি ওম"এর চেয়ে অনেক বেশী পরিণত ভাবে লেখা আর অভিনয়টাও বেশ দুর্দান্ত মাপা হয়েছে। দুই নাম্বার, গত ব্লগেই লিখেছিলাম যশরাজের সিনেমা মানেই গানে ভরা - আর এই সিনেমাতে, ভাবতে ভয় আর ভালো লাগে, একটাও গান নেই। ওই যে "জাবরা ফ্যান" গানটা দেখাচ্ছিল প্রোমোতে, ওটা সত্যিই শুধু প্রোমো। ব্যাস। আর কিছুই ভালো নেই এতে। স্ক্রিপ্টের লজিক "হ্যাপি নিউ ইয়ার"এর সাথে তুলনীয়। ট্রেনে ওঠার পর থেকে সংলাপ-স্টাইল মাঝে মাঝে "দিলয়ালে"কে হার মানায়। ডিওপি নিয়ে কি বলব - হালের মধ্যে "দেখ তামাশা দেখ" বা "কোর্ট"এর মত সস্তা সিনেমায় যা ক্যামেরাকাজ দেখিয়েছে, তার কাছে যেতে এইসব কমার্শিয়াল ছবির আরো একশো বছর লাগবে। ও হ্যাঁ, আর বোম্বের ওই হোটেলের ফাইট/চেজ সিকোয়েন্সটা আমার ব্যাপক লেগেছে, কিন্তু টেকনিক্যালি বোধ হয় খুব একটা ভালো না। এডিটিং প্রায় খুঁতহীন, কিন্তু পুরোটাই একেবারে টেক্সটবুক। যদি সত্যিই সত্যিই কোনো অ্যাস্পেক্টকে স্যালুট দিতে হয়, সেটা হল পোস্ট-প্রোডাকশন। হ্যাঁ মশাই, অপর্ণা সেন থেকে রবার্ট ডাউনি (জুঃ) সবাই বলেছেন যে ডিভিডি কমেন্টারি পর্যন্ত সবই পার্ট অফ দ্য ফিল্ম বলে গণ্য হবে।

তো এবার যে ট্রেন্ডের কথা হচ্ছিল, তাতে ফিরি। শাহরুখ তো নিজেকে রিপিট করে যাচ্ছেন, সে তো বলা হল। আরেকটা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মত ট্রিভিয়া প্রায়শঃই চোখ এড়িয়ে যায় (সেটা অবশ্যই সিনেমাগুণে)। দেখুন, আমরা যতই প্রাণের বন্ধু টন্ধু বলি না কেন, জানবেন আমার প্রবলতম প্রতিযোগী কিন্তু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, রুমমেট আর যে কলিগের সাথে রোজ টিফিন খাই। অতএব সে আর আমি একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার জন্যে একই ব্রান্ডের টি-শার্ট কিনব, আমাদের ম্যানেজার রা নতুন প্রসেস চালু করে আমাদের একই জায়গায় আঙ্গুল করবেন, নেতানেত্রীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই একসাথে রেজিস্টার করবেন আর আমির সলমন শাহরুখ সবাই আবার এই বুড়ো বয়সে ডবল রোল করবেন। এদিকে একবার কিন্তু হয়ে গেছে "ডুপ্লিকেট"/"জুড়য়া" তে। কিন্তু তাতে কার কী এসে যায় - অজয় দেবগ্ন আমিত কুমারের মত অত টাইট পুলিশ করার পরে আরেকবার নাক কেটে বাজীরাও সিঙ্ঘম করেননি?! আরো আছে, নীচে কয়েকটি উদাঃ দেওয়া হল

  ১। মুষ্টিযুদ্ধ > শাহরুখ@হ্যাপি নিউ ইয়ার, সলমন@সুলতান, আমির@দঙ্গল
  ২। প্যাক > আমির@গজনী, শাহরুখ@হ্যাপি নিউ ইয়ার, সলমন@কোথায় নেই?!
  ৩। ধর্মনিরপেক্ষতা > শাহরুখ@মাই নেম ইজ খান, সলমন@বজরঙ্গি ভাইজান, আমির@পিকে
  ৪। পুনর্যুবা ভবঃ > আমির@৩ ইডিয়টস, শাহরুখ@ফ্যান, আর ভাই তো অনন্ত যৌবনের দূত
  ৫। রেট্রো ফর মেট্রো > দিবাকর@ডিটেক্টিভ ব্যোমকেশ বকশী!, অনুরাগ@বোম্বে ভেলভেট

এই রে, এটা কী হল?! হঠাৎ আবার এঁরা কেন?! কেন, এনাদের নিয়ে কিছু বলা যাবে না নাকি?! শুনুন, বাকস্বাধীনতার উৎসবে মনে রাখা দরকার যে রবীন্দ্রনাথ আর গান্ধীদের খিস্তি মারা তো অনেক পুরনো ব্যাপার, আমাদের মুখে এখন নাসিরুদ্দিন শাহ বা ওম পুরীকেও ম্যানারিজম-আক্রান্ত বলতেও বাধে না। এখনকার হিসেবে ব্লাসফেমি তখনই হবে যখন সত্যজিত রায়ের ছবিগুলোকে তুলোধোনা করা শুরু হবে। তারপরে উষা উত্থুপ, পারলে ট্যারান্টিনো। ততক্ষণে "ফ্যান" দেখে নিন, আর তার পরে এই ভিডিওটা। আমি দিনে দিনে শ্রী কমল রশিদ খানের ফ্যান হয়ে যাচ্ছি ওনার ডিজেল-সততার জন্যে।



_________________________________
* নাকি উচ্চারণ টা হবে স্করসিজ, স্যাম্বাজারের মনসিজের মত?!

0 comments:

Post a Comment